হরিণখুরি চাল: সুন্দরবনের লুপ্তপ্রায় সুগন্ধী ধানের এক ঐতিহ্য
হরিণখুরি চাল সুন্দরবনের এক বিশেষ ধরনের সুগন্ধী দেশি চাল, যা বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায় ধানের প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। ১৮৭৬ সালে হান্টারের মেদিনীপুর ও হুগলি সংক্রান্ত সমীক্ষা গ্রন্থে এই চালের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা এর প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে। এছাড়াও, ১৯০১ সালে নিত্যগোপাল মুখোপাধ্যায় তাঁর লেখায় বর্ধমান অঞ্চলে এই ধানের চাষের কথা উল্লেখ করেছেন।
হরিণখুরি চালের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর স্বাদ ও সুগন্ধ। রান্নার পর এটি একটি মৃদু, মোহনীয় সুবাস ছড়ায় যা অন্যান্য চালের তুলনায় আলাদা। বিশেষত এটি পায়েস তৈরির জন্য উপযুক্ত বলে পরিচিত। এই চালের সহজপাচ্য গুণের কারণে এটি শিশু, বৃদ্ধ এবং রোগীদের খাদ্যতালিকায় সহজেই অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
এই ধানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এটি লবণাক্ত জমিতেও ভালোভাবে চাষ করা যায়। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলের কৃষকরা বর্তমানে এই ধানের পুনরুজ্জীবনে বিশেষভাবে উদ্যোগী হয়েছেন। জমির শতকরা ৩০ ভাগ লবণাক্ত হলেও এই ধান নির্বিঘ্নে চাষ করা সম্ভব, যা অন্যান্য অনেক জাতের ধানের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জিং হতে পারে।
হরিণখুরি ধানের চাষের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট জলবায়ু ও মাটির ধরন উপযুক্ত হওয়া দরকার। এই ধান বৃষ্টিপাতনির্ভর এলাকায় ভালো ফলন দেয় এবং বন্যার পানি সহ্য করার ক্ষমতা রয়েছে। এটি সাধারণত বর্ষাকালে রোপণ করা হয় এবং শীতকালে ফসল তোলা হয়।
হরিণখুরি চালের ঐতিহাসিক গুরুত্ব প্রমাণিত হয়েছে একাধিক গবেষণায়। ১৮৭৬ সালে হান্টারের সমীক্ষা গ্রন্থে এই ধানের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা এর প্রাচীনতা নির্দেশ করে।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিসিকেভি-এর গবেষণায় উঠে এসেছে এই ধানের কৃষিজ গুরুত্ব। গবেষণায় জানা গেছে, এই ধান অন্যান্য প্রচলিত ধানের তুলনায় বেশি সময় সংরক্ষণযোগ্য এবং এর প্রাকৃতিক সুগন্ধ দীর্ঘদিন বজায় থাকে।
গত বছর (২০২৪ সালের জুন মাসে) দিল্লিতে ‘প্রোটেকশন অব প্ল্যান্ট ভ্যারাইটিজ় অ্যান্ড ফার্মার্স রাইটস অথরিটি’ (PPV&FRA) থেকে হরিণখুরি চালকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, যা এর সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এছাড়া, সুন্দরবনের সাগরদ্বীপের একটি কৃষক সংগঠন এই ধানের সংরক্ষণে বিশেষ অবদান রাখার জন্য কেন্দ্রীয় পুরস্কার অর্জন করেছে।
হরিণখুরি চালের রঙ ও গঠনে বিশেষত্ব রয়েছে। হরিণের গায়ের রঙের সঙ্গে মিল থাকায় এটি ‘হরিণখুরি’ নামে পরিচিত। এই ধানের গায়ে হরিণের চোখের কাজলের মতো কালচে বেগুনি ফোঁটা দেখা যায়, যা একে আরও আলাদা বৈশিষ্ট্য প্রদান করে। চালের দানা মাঝারি আকারের এবং রান্নার পর এটি নরম ও তুলতুলে হয়ে যায়।
হরিণখুরি চাল শুধু পায়েস নয়, খই ও চিঁড়ে তৈরিতেও ব্যবহৃত হয়। জয়নগরের বিখ্যাত মোয়ার জন্য যে কনকচূড় চাল ব্যবহৃত হয়, তার মতোই হরিণখুরি চালের খই ও চিঁড়েও অত্যন্ত সুস্বাদু।
এই ধানে প্রাকৃতিক খনিজ ও ভিটামিন রয়েছে, যা হজম শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। বিশেষত এতে থাকা ফাইবার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
সোঁয়াযুক্ত এই ধানের ফলন হেক্টরপ্রতি আড়াই থেকে তিন টন হয়, যা কৃষকদের জন্য লাভজনক হতে পারে। যেহেতু এটি লবণাক্ত জমিতে ভালো ফলন দেয়, তাই এটি উপকূলবর্তী অঞ্চলের কৃষকদের জন্য একটি বড় সুযোগ এনে দিতে পারে। এছাড়া, এই চালের বাজারমূল্য তুলনামূলক বেশি হওয়ায় কৃষকদের আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনাও রয়েছে।
হরিণখুরি চাল সংরক্ষণ ও চাষ সম্প্রসারণের জন্য সরকার ও কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন। কৃষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান, উন্নত চাষ পদ্ধতির প্রচলন, এবং বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে এই চালের পুনরুজ্জীবন সম্ভব।
হরিণখুরি চাল শুধুমাত্র একটি সুগন্ধী ধান নয়, এটি বাংলার কৃষি ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। লবণাক্ত জমিতে এর টিকে থাকার ক্ষমতা এবং স্বাদ ও পুষ্টিগুণের জন্য এটি সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবনের যোগ্য। সরকারি স্বীকৃতি ও কৃষক সংগঠনের প্রচেষ্টায় এই বিলুপ্তপ্রায় ধান ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃতভাবে চাষ ও প্রচারিত হতে পারে।
এই চাল জৈব চাষের দ্বারা উৎপন্ন। উৎপাদকদের পক্ষ থেকে কোনোরকম কীটনাশক বা ক্যামিক্যাল সার এই ফসল উৎপন্ন করতে ব্যবহার করা হয়নি।
Anshul Mehta (verified owner) –
Davinder (verified owner) –
Ansel (verified owner) –
Dipen Mukherjee (verified owner) –
Bernardo (verified owner) –